শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:১১ অপরাহ্ন

আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর মুনাফিক প্রকাশ হওয়ার ঘটনাঃ সূরা মুনাফিকুনের শানে নুযুল ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর

আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর মুনাফিক প্রকাশ হওয়ার ঘটনাঃ সূরা মুনাফিকুনের শানে নুযুল ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর

এই ঘটনা হযরত ইসহাক (রহঃ)-এর রেওয়াত অনুযায়ী ষষ্ঠ হিজরীতে এবং কাতহাদাহ ও ওরওয়া (রহ)-এর রেওয়াত অনুযায়ী পঞ্চম হিজরীতে ‘বনিল-মুস্তালিক’ যুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়। — [তাফসীরে মাযহারী ও তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন] ঘটনার পূর্ণ বিবরণ এই যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) সংবাদ পান যে, ‘মুস্তালিক’ গোত্রের সরদার হারেস ইবনে যেরার তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই হারেস ইবনে যেরার হযরত জুয়ায়রিয়া (রাঃ)-এর পিতা, যিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হারেস ইবনে যেরারও পরে মুসলমান হয়ে যায়।
সংবাদ পেয়ে রসুলে করীম (সাঃ) একদল মুজাহিদসহ তাদের মোকালো করার জন্যে বের হন। এই জেহাদে গমনকারী মুসলমানদের সঙ্গে অনেক মুনাফিকও যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশীদার হওয়ার লোভে রওয়ানা হয়। কারণ, তারা অন্তরে কাফের হলেও বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর সাহায্যে তিনি বিজয়ী হবেন।
রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মুস্তালিক গোত্রে পৌঁছলেন, তখন ‘মুরাইসী’ নামে খ্যাত একটি কূপের কাছে হারেস ইবনে যেরারের বাহিনীর সম্মাখীন হলেন। এ কারণেই এই যুদ্ধকে মুরাইসী যুদ্ধও বলা হয়। উভয়পক্ষ সারিবদ্ধ হয়ে তীর বর্ষণের মাধ্যমে মোকাবেলা করল। মুস্তালিক গোত্রের বহুলোক হতাহত হল এবং অবশিষ্টরা পলায়ন করতে লাগল। আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বিজয় দান করলেন। প্রতিপক্ষের কিছু ধন-সম্পদ এবং কয়েকজন পুরুষ ও নারী মুসলমানদের হাতে বন্দী হল। এভাবে এই জেহাদের সমাপ্তি ঘটল।
এরপর যখন মুসলমান মুজাহিদ বাহিনী মুরাইসী কূপের কাছেই সমবেত ছিল, তখন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল যা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মুনাফিক প্রকাশ হওয়ার মূল ঘটনা এখান থেকেই শুরু। ঘটনা এই যে, একজন মুহাজির (যারা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছিনে) ও একজন আনসারীর (যারা মুহাজিরদের আশ্রয় দান করেছিলেন) মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে হাতাহাতির সীমা অতিক্রম করে পারষ্পরিক সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌঁছে গেল। মুহাজির ব্যক্তি সাহায্যের জন্যে মুহাজিরগণকে এবং আনসারী ব্যক্তি আনসার সম্প্রদায়কে ডাক দিল। উভয়ের সাহায্যার্থে কিছু লোক তৎপর হয়ে উঠল। এভাবে ঘটনাটি মুসলমানদের পারষ্পরিক সৎংঘর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। রসুলুল্লাহ (সাঃ) সংবাদ পেয়ে অনতিবিলম্বে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন এবং ভীষণ রুষ্ট হয়ে বললেনঃ “এ কি মূর্খতা যুগের আহবান? দেশ ও বংশগত জাতীয়তাকে ভিত্তি করে সাহায্য ও সহযোগীতার আয়োজন হচ্ছে কেন?” তিনি আরও বললেন, “এই শ্লোগান বন্ধ কর। এটা দুর্গন্ধময় শ্লোগান। তিনি বললেন, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত অপর মুসলমানের সাহায্য করা—সে জালেম হোক অথবা মজলুম। মজলুমকে সাহায্যূ করার অর্থ তো জানাই যে, তাকে জুলুম থেকে রক্ষা করা। জালেমকে সাহায্য করার অর্থ তাকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত করা। এটাই তার প্রকৃত সাহায্য।” উদ্দেশ্য এই যে, প্রত্যেক ব্যাপারে দেখা উচিত কে জালেম ও কে মজলুম। এরপর মুহাজির, আনসারী, গোত্র ও বংশ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানদের কর্তব্য মজলুমকে জুলুম থেকে রক্ষা করা এবং জালেমের হাত চেপে ধরা- সে আপন সহোদর ভাই হোক অথবা পিতা হোক। এই দেশ ও বংশগত জাতীয়তা একটা মূর্খতাসুলভ দুর্গন্ধময় শ্লোগান। এর ফল জঞ্জাল বাড়ানো ছাড়া কিছুই হয় না।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপদেশবাণী শোনামাত্রই ঝগড়া মিটে গেল। এ ব্যাপারে মুহাজির জাহজাহের বাড়াবাড়ি প্রমাণিত হল। তার হাতে সিনান ইবনে সামেত (রাঃ) তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাফ করিয়ে নিলেন। ফলে ঝঘড়াকারী জালেম ও মজলুম উভয়ই পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেল।
মুনাফিকদের যে দলটি যুদ্ধলব্ধ সম্পদের লালসায় মুসলমানদের সাথে আগমন করেছিল। তাদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যখন মুহাজির ও আনসারীর পারষ্পরিক সংঘর্ষের খবর পেল, তখন সে একে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নিল। সে মুনাফিকদের এক মজলিসে, যাতে মুমিনদের মধ্যে কেবল যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন, আনসারকে মুহাজিরগণের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বললঃ তোমরা মুহাজিরদেরকে দেশে ডেকে এনে মাথায় চড়িয়েছ, নিজেদের ধন-সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি তাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছ। তারা তোমাদের রুটি খেয়ে লালিত হয়ে এখন তোমাদেরই ঘাড় মটকাচ্ছে। ‍যদি তোমাদের এখনও জ্ঞান ফিরে না আসে, তবে পরিণামে এরা তোমাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলবে। কাজেই তোমরা ভবিষ্যতে ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যাবে। এখন তোমাদের কর্তব্য এই যে, মদীনায় ফিরে গিয়ে সম্মানীরা বহিরাগত এসব বাজে (নাউযুবিল্লাহ) লোকদের বহিষ্কার করে দিবে তথা মদীনা থেকে তাড়িয়ে দিবে।
সম্মানী বলে তার উদ্দেশ্য ছিল নিজের দল ও আনসার এবং বাজে লোক বলে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) একথা শোনা মাত্রই বলে উঠলেনঃ আল্লাহর কসম, তুই-ই বাজে লোক, লাঞ্চিত ও ঘৃণিত! পক্ষান্তরে রসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ্ প্রদত্ত শক্তিবলে এবং মুসলমানদের ভালবাসার জোরে মহাসম্মানী।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ইচ্ছা ছিল যে, বিপদ দেখলে সে তার কপটতার উপর পর্দা ফেলে দিবে। তাই সে স্পষ্ট ভাষা ব্যবহার করে নি। কিন্তু যায়েদ ইবনে আরকামের ক্রোধ দেখে তার সম্বিৎ ফিরে এল। পাছে তার কুফর প্রকাশ হয়ে পড়ে, এই আশংকায় সে হযরত যায়েদের কাছে ওযর পেশ করে বললঃ আমি তো এ কথাটি হাসির ছেলে বলেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে কিছু করা ছিল না।
যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) মজলিস থেকে উঠে সোজা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং আদ্যেপান্ত ঘটনা তাঁকে বলে শোনালেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে সংবাদটি খুবই গুরুতর মনে হল। মুখমন্ডলে পরিবর্তনের রেখা ফুটে উঠল। যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) অল্প বয়ষ্ক সাহাবী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেনঃ বৎস দেখ, তুমি মিথ্যা বলছ না তো? যায়েদ কসম খেয়ে বললেনঃ না, আমি নিজ কানে এসব কথা শুনেছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবার বললেনঃ তোমার কোনরূপ বিভ্রান্তি হয়নি তো? যায়েদ উত্তরে পূর্বের কথাই বললেন। এপর মুনাফিক সরদারের এই কথা গোটা মুসলমান বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে এ ছাড়া অন্য কোন আলোচনাই রইল না। এদিকে সব আনসার যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-কে তিরষ্কার করতে লাগলেন যে, তুমি সম্প্রদায়ের নেতার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করেছ এবং আত্নীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছ। যায়েদ (রাঃ) বললেনঃ আল্লাহর কসম, সমগ্র খাযরাজ গোত্রের মধ্যে আমার কাছে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অপেক্ষা অধিক প্রিয় কেউ নেই। কিন্তু যখন সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে এসব কথাবার্তা বলেছে, তখন আমি সহ্য করতে পারিনি। যদি আমার পিতাও এসব কথা বলত তবে আমি তাও রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গোচরীভূত করতাম।
অপরদিকে হযরত ওমর (রাঃ) এসে আরয করলেনঃ ইয়া রসূলুল্লাহ্! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। কোন কোন বর্ণনায় আছে হযরত ওমর (রাঃ) এ কথাও বলেছিলেনঃ আপনি ওব্বাদ ইবনে বিশরকে আদেশ করুন, সে তার মস্তক কেটে আপনার সামনে উপস্থিক করুক।
রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ ওমর, এর কি প্রতিকার যে, মানুষের মধ্যে খ্যাত হয়ে যাবে আমি আমার সাহাবীকে হত্যা করি। অতঃপর তিনি মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইকে হত্যা করতে বারণ করে দিলেন। হযরত ওমর (রাঃ)-এর এই কথা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র জানতে পারলেন। তাঁর নামও আব্দুল্লাহ ছিল। তিনি খাঁটি মুসলমান ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে আরয করলেনঃ যদি আপনি আমার পিতাকে এসব কথাবার্তার কারণে হত্যা করার ইচ্ছা রাখেন, তবে আমাকে আদেশ করুন, আমি নিজে তার মস্তক কেটে আপনার কাছে এই মজলিস ত্যাগ করার পূর্বে হাযির করব (সুবহানাল্লাহ- কী শক্তিশালী ঈমানের অধিকারী!)। তিনি আরও আরয করলেনঃ সমগ্র খাজরাজ গোত্র সাক্ষী, তাদের মধ্যে কেউ আমা অপেক্ষা অধিক পিতামাতার সেবা ও আনুগত্যকারী নেই। কিন্তু আল্লাহ্ ও রসূলের বিরুদ্ধে তাদেরও কোন বিষয় সহ্য করতে পারব না। আমার আশংকা যে, আপনি যদি অন্য কাউকে আমার পিতাকে হত্যা করার আদেশ দান এবং সে তাকে হত্যা করে, তবে আমি আমার পিতৃহত্যাকে চোখের সামনে চলা-ফেরা করতে দেখে হয়ত আত্নসম্বরণ করতে পারব না। এটা আমার জন্য আযাবের কারণ হবে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ তাকে হত্যা করার ইচ্ছা আমার নেই এবং আমি কাউকে এ বিষয়ে আদেশও করিনি।
এই ঘটনার পর রসূলুল্লাহ (সাঃ) সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে অসময়ে সফর শুরু করার কথা ঘোষণা করে দিলেন এবং নিজে ‘কসওয়া’ নামক উষ্ট্রীর পিঠে সওয়ার হয়ে গেলেন। যখন সাহাবায়ে কেরাম রওয়ানা হয়ে গেলেন, তখন রসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইকে ডেকে এনে বললেনঃ তুমি কি বাস্তবিকই এরূপ কথা বলেছে? সে অনেক কসম খেয়ে বললঃ আমি কখনও এরূপ কথা বলিনি। এই বালক (যায়েদ ইবনে আরকাম) মিথ্যাবাদী। স্বগোত্রে আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের যথেষ্ট সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। তারা সবাই স্থির করল যে, সম্ভবতঃ যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) ভুল বুঝেছে। আসলে ইবনে উবাই একথা বলেনি।
মোটকথা, রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইবনে উবাইয়ের কসম ও ওযর কবুল করে নিলেন। এদিকে জনগণের মধ্যে যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে ক্রোধ ও তিরষ্কার আরও তীব্র হয়ে গেল। তিনি এই অপমানের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে জীবন যাপন করতে লাগলেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) সমগ্র মুজাহিদ বাহিনীসহ সারাদিন ও সারারাত সফর করলেন এবং পরের দিন সকালেও সফর অব্যাহত রাখলেন। অবশেষে সূর্যকিরণ প্রখর হতে লাগল, তখন তিনি কাফেলাকে এক জায়গায় থামিয়ে দিলেন। পূর্ণ একদিন একরাত সফরের ফলে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সাহাবায়ে কেরাম মনযিলে অবস্থানের সাথে সাথে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।
বর্ণনাকারী (রাবী) বলেনঃ সাধারণ অভ্যাসের বিপরীতে তাৎক্ষণিক ও অসময়ে সফর করা এবং সুদীর্ঘকাল সফর অ্যাহত রাখার পিছনে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের ঘটনা থেকে উদ্ভূত জল্পনা-কল্পনা হতে মুজাহিদদের ‍দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেয়া, যাতে এ সম্পর্কিত চর্চার অবসান ঘটে।
এরপর রসূলুল্লাহ (সাঃ) পূনরায় সফর শুরু করলেন। ইতিমধ্যে ওবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইকে উপদেশচ্ছলে বরলেনঃ তুমি এক কাজ কর। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অপরপাধ স্বীকার করে নাও। তিনি তোমার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন। এতে তোমার মুক্তি হয়ে যেতে পারে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এই উপদেশ শুনে মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। হযরত ওবাদা (রাঃ) তখনই বললেনঃ আমার মনে হয়, তোমার এই বিমূখতা সম্পর্কে অবশ্যই কোরআনের আয়াত নাযিল হবে।
এদিকে সফর চলাকালে যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বার বার রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আসতেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এই মুনাফিক লোকটি আমাকে মিথ্যাবাদী বলে গোটা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। অতএব আমার সত্যায়ন ও এই ব্যাক্তির মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন সম্পর্কে অবশ্যই কোরআন নাযিল হবে। হঠাৎ যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) দেখলেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মধ্যে ওহী নাযিলের লক্ষণাদি ফুটে উঠেছে। তাঁর শ্বাস ফুলে উঠেছে, কপাল ঘর্মাক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং তাঁর উষ্ট্রী বোঝার ভারে নুয়ে পড়ছে। যায়েদ (রাঃ) আশাবাদী হলেন যে, এখন এ সম্পর্কে কোন ওহী নাযিল হবে। অবশেষে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই অবস্থা দূর হয়ে গেল। যায়েদ (রাঃ) বলেনঃ আমার সওয়ারী রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছ ঘেঁষে যাচ্ছিল। তিনি নিজের সওয়ারীর উপর থেকেই আমার কান ধরলেন এবং বললেনঃ “হে বালক, আল্লাহ তা’আলা তোমার কথার সত্যায়ন করেছেন এবং সর্ম্পূর্ণ সূরা মুনাফিকূন আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।” কোন কোন বর্ণনায় আছে, যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) অপমানের ভয়ে গৃহে আত্নগোপন করেন, তখন আল্লাহ যায়েদ (রাঃ) এর পক্ষ হয়ে সূরা মুনাফিকূন নাযিল করে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করেন।
আরেক বর্ণনায় রয়েছে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন মদীনার নিকটবর্তী আকিক উপত্যকায় পৌঁছেন, তখন এই মুনাফিক সর্দারের মুমিন পুত্রও হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসহর হন এবং খুঁজতে খুঁজতে পিতা ইবনে উবাইয়ের কাছে পৌঁছে তাঁর উষ্ট্রীকে বসিয়ে দেন। তিনি উষ্ট্রীর হাঁটুতে পা রেখে পিতাকে বললেনঃ আল্লাহর কসম, তুমি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না যে পর্যন্ত ‘সম্মানী বাজে লোক বহিষ্কৃত করবে’- এ কথার ব্যাখ্যা না কর। এই বাক্যে সম্মানী কে? রসূলুল্লাহ (সাঃ), না তুমি? পুত্র পিতার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিল এবং যারা এ পথ অতিক্রম করছিল তারা পুত্র আব্দুল্লাহকে তিরষ্কার করছিল যে, পিতার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করছ কেন? অবশেষে যখন রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উষ্ট্রী তাদের কাছে আসল, তখন তিনি এর ব্যাপার জিজ্ঞাসা করলেন। লোকেরা বললঃ আব্দুল্লাহ্ এই বলে পিতার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তুমি মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না! রসূলুল্লাহ (সাঃ) দেখলেন যে, মুনাফিক ইবনে উবাই বেগতিক হয়ে পুত্রের কাছে বলে যাচ্ছেঃ আমি তো ছেলেপিলে ও নারীদের চাইতেও লাঞ্চিত। একথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাঃ) পুত্রকে বললেনঃ তার পথ ছেড়ে দাও, তাকে মদীনায় যেতে দাও।
উপরোক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতেই পবিত্র কোরআনের ৬৩ নম্বর সূরা, ‘সূরা মুনাফিকূন’ মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্পর্কে নাযিল হয়। উক্ত সূরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, “মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।” অর্থাৎ এই মুনাফিকরা মিথ্যা কসম খেয়ে খেয়ে দুনিয়াবি স্বার্থ লাভের জন্য আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল।” আর আল্লাহও জানিয়ে দিলেন যে, মুনাফিকদের এইসব কসম সবই মিথ্যা, তাদের কথা বিশ্বাস করবেন না। এই মুনাফিক সরদারের হিতাকাঙ্খায় কেউ কেউ তাকে বললঃ এখনও সময় আছে, তুই রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে হাযির হয়ে অপরাধ স্বীকার করে নে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) তোর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। সে উত্তরে বললঃ “তোমরা আমাকে বিশ্বাস (ঈমান আনতে বলেছিলে) স্থাপন করতে বলেছিলে, সেমতে আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। এরপর তোমরা আমাকে অর্থ-সম্পদের যাকাত দিতে বলেছিলে, আমি তাও দিতেছি। এখন আর কী বাকি রইল? আমি কি মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সেজদা করব।” এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এই সূরার পাঁচ ও ছয় নং আয়াতে বলেনঃ “যখন তাদেরকে বলা হয়ঃ তোমরা এস, আল্লাহর রসূল তোমাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন, তখন তারা মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং আপনি তাদেরকে দেখবেন যে, তারা অহংকার করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আপনি তাদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন অথবা না করুন, উভয়ই সমান। আল্লাহ কখনও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।” অর্থাৎ যখন ইবনে উবাইয়ের অন্তরে ঈমানই নেই, তখন তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা উপকারী হতে পারে না।
আনসার ও মুহাজির সাহাবী (রাঃ)-দের কথা কাটাকাটির সময় ইবনে উবাই বলেছিলে যে, “তোমরা মুহাজিরদেরকে দেশে ডেকে এনে মাথায় চড়িয়েছ, নিজেদের ধন-সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি তাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছ। তারা তোমাদের রুটি খেয়ে লালিত হয়ে এখন তোমাদেরই ঘাড় মটকাচ্ছে। ‍যদি তোমাদের এখনও জ্ঞান ফিরে না আসে, তবে পরিণামে এরা তোমাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলবে। কাজেই তোমরা ভবিষ্যতে ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যাবে। এখন তোমাদের কর্তব্য এই যে, মদীনায় ফিরে গিয়ে সম্মানীরা বহিরাগত এসব বাজে লোকদের বহিষ্কার করে দিবে তথা মদীনা থেকে তাড়িয়ে দিবে।” এই কথার জওয়াবে উক্ত সূরার সাত নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “তারাই বলেঃ আল্লাহর রাসূলের সাহচর্যে যারা আছে তাদের জন্যে ব্যয় করো না। পরিণামে তারা আপনা-আপনি সরে যাবে। ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের ধন-ভান্ডার আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না।” অর্থাৎ নির্বোধরা মনে করে মুহাজিরগণ তাদের দান-খয়রাতের মুখাপেক্ষী এবং ওরাই তাদের অন্ন যোগায়। অথচ সমগ্র নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে ধন-ভাণ্ডার আল্লাহর হাতে। তিনি ইচ্ছা করলে মুহাজিরগণকে তোমাদের কোন সাহায্য ছাড়াই সবকিছু দিতে পারেন। এই মুনাফিক সরদারের এরূপ মনে করা নির্বুদ্ধিতা ও বোকামীর পরিচায়ক। তাই কোরআন পাক এ স্থলে লা-ইয়াফক্বাহূনা বলে ব্যক্ত করেছে যে, যে এরূপ মনে করে, সে বেওকুফ ও নির্বোধ। আব্দুলল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পাক পরবর্তি আট নং আয়তে বলেন, “তারাই বলেঃ আমরা যদি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি তবে সেখান থেকে সবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিস্কৃত করবে। শক্তি তো আল্লাহ তাঁর রসূল ও মুমিনদেরই কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।” অর্থাৎ ইবনে উবাইয়ের উক্তিটি হুবুহু আল্লাহ এই আয়াতে তুলে ধরে জওয়াব দিয়েছেন যে, যদি ইযযতওয়ালারা ‘হেয়’ লোকদেরকে বের করেই দেয়, তবে এর কুফল তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবেঃ। কেনন, ইযযত তো আল্লাহর, তাঁর রসুলের এবং মুমিনদের প্রাপ্য। কিন্তু মূর্খতার কারণে তোমরা এ সম্পর্কে বে-খবর। এর মানে হলোঃ কোন মানুষ নিজেকে অন্যের রিযিকদাতা মনে করলে এটা নিরেট জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপন্থী এবং নির্বুদ্ধিতার আলামত। পক্ষান্তরে ইযযত ও অপমান দুনিয়াতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনে লাভ করে। তাই এতে বিভ্রান্তি হলে সেটা বেখবর ও অনভিজ্ঞ হওয়ারই প্রমাণ।
সূরা মুনাফিকূনের শেষ তিন আয়াতের অর্থ ও তার সংক্ষিপ্ত তাফসীরঃ-
আয়াত নং নয়ঃ “মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” আয়াত নং দশঃ “আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।” আয়াত নং এগারঃ “প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।” [আয়াত নং ৯-১১]
উপরোক্ত তিনটি আয়াত সূরা মুনাফিকূনের শেষ রুকু। প্রথম রুকুতে মুনাফিকদের মিথ্যা শপথ ও চক্রান্ত উল্লেখ করা হয়েছিল। দুনিয়ার মহব্বতে পরাভূত হওয়াই ছিল এসব কিছুর সারমর্ম। এ কারণেই তারা একদিকে মুসলমানদের কবল থেকে আত্নরক্ষা এবং অপরদিকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদে ভাগ বসাবার উদ্দেশ্যে বাহ্যাতঃ নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করত। মুহাজির সাহাবীদের পিছনে ব্যয় করার ধারা বন্ধ করার যে চক্রান্ত তারা করেছিল, এর পশ্চাতেও এ কারণই নিহিত ছিল। এই দ্বিতীয় রুকুতে খাঁটি মুমিনদেরকে সম্বোধন করে সতর্ক করা হয়েছে যে, তোমরা মুনাফিকদের ন্যায় দুনিয়ার মহব্বতে মগ্ন হয়ে যেয়ো না। যেসব বিষয় মানুষকে দুনিয়াতে আল্লাহ্ থেকে গাফেল করে, তন্মধ্যে সর্ববৃহৎ দুটি জিনিস হলো “ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি।” তাই এই রুকুর প্রথম আয়াতেই এই দু’টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ-সম্ভারই উদ্দেশ্য। আয়াতের সারমর্ম এই যে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মহব্বত সর্বাবস্থায় নিন্দনীয় নয় বরং এ গুলো নিয়ে ব্যাপৃত থাকা এক পর্যায়ে কেবল জায়েযই নয়- ওয়াজিবও হয়ে যায়। কিন্তু সর্বদা এই সীমানার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এসব বস্তু যেন মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে দেয়। এখানে ‘আল্লাহর স্মরণের’ অর্থ কোন মোফাসসিরের মতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায, কারও মতে হজ্ব ও যাকাত এবং কারও মতে কোরআন। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেনঃ স্মরণের অর্থ এখানে যাবতীয় আনুগত্য ও ইবাদত। এই অর্থ সব কিছুতে পরিব্যাপ্ত।– [কুরতুবী]
তবে সাবধান থাকতে হবে যে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির জন্য এমনভাবে ডুবে থাকা যাবে না যে, যা দ্বারা মৃত্যুর পরের জীবনে শাস্তির সম্মুখিন হতে হবে। বাস্তবাতায় দেখা যায় এই দুটি জিনিসের পিছনেই মানুষ ছুটছে দেশ হতে দেশান্তরে। চলছে ব্যক্তিতে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে অন্যায়, অনাচার, লুটতারাজ, খুনাখুনি, হানা হানি ইত্যাদি। এই জন্যই মহান আল্লাহ পাক সূরা আনফালে বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য ফিৎনা।” আবার সূরা ত্বোয়াহায় আল্লাহ বলেছেন, “আমি তো তোমাদের কাছ থেকে রিযিক চাইনা (অর্থাৎ আমি কি তোমাদের কাছ থেকে রিযিক চেয়েছি যে, তোমরা নামাযের মত ইবাদত বাদ দিয়ে রিযিকের পিছনে লেগে থাকবে?) বরং আমিই তো তোমাদের রিযিক দিয়ে থাকি।”
দশ নং আয়াতের তাফসীরঃ এই আয়াতে মৃত্যু আসার অর্থ মৃত্যুর লক্ষণাদি সামনে আসার আগেই স্বাস্থ্য ও শক্তি অটুট থাকা অবস্থায় তোমাদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে পরকালের পুঁজি করে নাও। নতুবা মৃত্যুর পর এই ধন-সম্পদ তোমাদের কোনই কাজে আসবে না। পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহর স্মরণের’ অর্থ যাবতীয় এবাদত ও শরীয়তের আদেশ-নিষেধ পালন করা। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ধন-সম্পদ ব্যয় করাও এর অন্তর্ভূক্ত। এরপর এখানে অর্থ ব্যয় করাকে পৃথকভাবে বর্ণনা করার দু’টি কারণ হতে পারে। (এক) আল্লাহ্ ও তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনে মানুষকে গাফেলকারী সর্ববৃহ’ বস্তু হচ্ছে ধন-সম্পদ। তাই যাকাত, ওশর, হজ্ব ইত্যাদি আর্থিক ইবাদত স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। (দুই) মৃত্যুর লক্ষণাদি দৃষ্টির সামনে আসার সময় কারও সাধ্য নেই এবং কেউ কল্পনাও করতে পারে না যে, কাযা নামাযগুলো আদায় করে নেবে, কাযা হজ্ব আদায় করবে অথবা কাযা রোযা রাখবে, কিন্তু ধন-সম্পদ সামনে থাকে এবং এ বিশ্বাস হয়েই যায় যে, এখন এই ধন তার হাত থেকে চলে যাবে। তখনও তাড়াতাড়ি ধন-সম্পদ ব্যয় করে আর্থিক এবাদতের ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া দান-খয়রাত যাবতীয় আপদ-বিপদ দূর করার ব্যাপারেও কার্যকর।
সহীহ বোখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেনঃ কোন সদকায় সর্বাধিক সওয়াব পাওয়া যায়? তিনি বললেনঃ যে সদকা সুস্থ অবস্থায় এবং ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য করে- অর্থ ব্যয় করে ফেললে নিজেই দরিদ্র হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকা অবস্থায় করা হয়। তিনি আরও বললেনঃ আল্লাহর পথে তথা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করাকে সেই সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করো না যখন আত্না তোমার কণ্ঠনালীতে এসে যায় এবং তুমি মরতে থাক আর বলঃ এই পরিমাণ অর্থ অমুককে দিয়ে দাও, এই পরিমাণ অর্থ অমুক কাজে ব্যয় কর।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের তফসীরে বলেন, যে ব্যক্তির ‍যিম্মায় যাকাত ফরয ছিল; কিন্তু আদায় করেনি অথবা হজ্ব ফরয ছিল কিন্তু আদায় করেনি, সে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে আল্লাহ তা’আলার কাছে বাসনা প্রকাশ করে বলবেঃ আমি আবার দুনিয়াতে ফিরে যেতে চাই—অর্থাৎ মৃত্যু আরও কিছু বিলম্বে আসুক, যাতে আমি সদকা-খয়রাত করে নেই এবং ফরয কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে যাই। ওয়া আকুম মিনাচ্ছ্বলিহীন অর্থাৎ কিছু সময় অবকাশ পেলে এমন সৎ কর্ম করে নেব, যদ্দ্বারা সৎকর্ম পরায়ণদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব। যেসব ফরয বাদ পড়েছে, সেগুলো পূর্ণ করে নেব এবং যেসব হারাম ও মাকরূহ কাজ করেছি, গেুলো থেকে তওবা করে নেব। কিন্তু আল্লাহ সর্বশেষ এগার নং আয়াতে বলে দিয়েছেন যে, মৃত্যু আসার পার কাউকে অবকাশ দেয়া হয় না। সুতরাং এই বাসনা নিরর্থক।
উক্ত ঘটনা ও সূরা মুনাফিকূনের শিক্ষাঃ-
১। আল্লাহর রসূল (সাঃ) ও তার কাজকে নিজের মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ এমনকি নিজের জীবনের চাইতেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২। মুনাফেকি প্রকাশ হয়ে পড়বে এমন কথা ও কাজ থেকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে।
৩। নিজেকে অন্যের রিযিকের কারণ মনে করা যাবে না। সবার রিযিক আল্লাহই দিয়ে থাকেন। তবে কারো জিম্মায় কোন মানুষকে অধিনস্ত করে রেখে জিম্মাদার ব্যক্তিকে আল্লাহ পরীক্ষা করে থাকেন এ কথা সবসময় মনের মধ্যে জাগ্রত রাখা।
৪। আল্লাহ নিজ ক্ষমতায় যে কোন সময় যে কোন ব্যক্তির কাছ থেকে ধন-সম্পদ কেড়ে নিতে পারেন।
৫। ধন-সম্পদ ও সন্তানদের পিছনে মেহনত করা কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়াজিব।
৬। ধন-সম্পদ বৃদ্ধি ও সন্তান-সন্ততির সুখের জন্য এমনভাবে মেহনতে জড়িয়ে পড়া যাবে না যে, আল্লাহর ফরজ, ওয়াজিব ইবাদত-বন্দেগী ছুটে যাবে।
৭। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের উপর পরীক্ষাস্বরূপ।
৮। সময়মত যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী আদায় করে ফেলা এবং পরে করব এই অপেক্ষায় না থাকা।
৯। প্রত্যেক মানুষেরই সময় নির্দিষ্ট; কারও মৃত্যু আগ-পিছু করা হয় না।
১০। ইবাদতে গাফেল ব্যক্তি প্রত্যেকেই মৃত্যুর সময় আল্লাহর কাছে কিছুকাল অবকাশ চায় কিন্তু আল্লাহ কাউকে কোনরূপ অবকাশ দেন না।

লেখকঃ-
হাফেজ-ক্বারী মোঃ ফখরুল ইসলাম, এম কম (একাউন্টিং)
সিনিয়র অফিসার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
বকশীগঞ্জ শাখা, জামালপুর।
Contact Address: fakhrulibbl@gmail.com
IMO & WhatsApp: 00880175866173

Youtube : Hudhud TV BD

সময়ের ধারা সংবাদটি শেয়ার করুন এবং আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

© All rights reserved © somoyerdhara.com
Desing by Raytahost.com