শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:২৯ অপরাহ্ন

সম্ভাবনার ২০২২: শিক্ষায় রোল মডেল বাংলাদেশ

সম্ভাবনার ২০২২: শিক্ষায় রোল মডেল বাংলাদেশ

শিক্ষায় এখন রোল মডেল বাংলাদেশ। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা আর শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে দেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। দেশে নারী শিক্ষায় গত ১০ বছরে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদের থেকে ছাত্রীসংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে মেয়েদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হার তুলনামূলকভাবে বেশি এবং প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছেলেদের তুলনায় কম। এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলে সাফল্যের এ ধারা ধরে রেখেছে মেয়েরা।
করোনা মহামারি এসব অর্জনকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। বেড়েছে ঝরে পড়ার হার ও বাল্যবিয়ে। তবে আশার কথা, প্রায় চার মাস ধরে সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রম চলছে সীমিত আকারে। স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়াও এখন শেষ পর্যায়ে, কিন্তু করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শঙ্কার মধ্যেও শিক্ষায় আবারও এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইস্ট প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, সরকার অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে- এটা ভালো উদ্যোগ। দেশের সব শিক্ষার্থী যেন এ ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারে সে ব্যবস্থার পাশাপাশি অভিজ্ঞ শিক্ষক তৈরি করতে হবে। উৎপাদনশীল শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির বিষয়ে তিনি জোর দেন।
বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষায় সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এতে লাগাতার ১৭ মাস সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এরপরও প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম শ্রেণিকক্ষে সশরীরে বন্ধ থাকলেও চালু ছিল অনলাইন ক্লাস, হয়েছে পরীক্ষাও। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেন বিঘ্নিত না হয় সে লক্ষ্যে গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাস ভিডিও ধারণ করে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে সম্প্রচার এখনও চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ‘শিক্ষা টিভি’ পরিচালনার নিমিত্তে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপনে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষায় সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে দেশকে। উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশগামিতা কমেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এর উল্টো চিত্রই দেখা গেছে। পাশের দেশের শিক্ষার্থীরা এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশকেই তাদের পছন্দের তালিকায় রাখছেন।
তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই স্বর্ণযুগে আইটিনির্ভর জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়কে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশের ১২টির মতো তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার সম্পর্কে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অজ্ঞতা দূর হয়েছে। এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা বিস্তৃত হওয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্ব এখন শিক্ষার্থীদের হাতের মুঠোয়। এখন প্রায় প্রতিটি স্কুলে রয়েছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা। বিশ্বব্যাংক তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করে তুলে ধরেছে সরকারের উদ্যোগ ও অর্জনের নানাদিক।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ‘বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দ্রুতগতিতে দুস্তর পথ অতিক্রম করেছে এবং শিক্ষায় সমতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছে। এক্ষেত্রে লাখ লাখ শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা, নারী সাক্ষরতা বৃদ্ধি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত রাখতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। শিক্ষা ও গবেষণা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবন, গবেষণায় প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাকে আরও সহজলভ্য করতে সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে দেশের যেসব উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজ নেই সেসব উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয় এবং একটি কলেজ সরকারিকরণ করা হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) এমপিও নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে গত এক বছরে স্নাতক ও সমমান পর্যায়ে ১ লাখ ৮২ হাজার ১০৩ জন দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বাবদ ৯৭ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৫৮০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণ করছে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩২ লাখ ৭১ হাজার ৫৯ জন দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীর মধ্যে উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বাবদ ৮৭০ কোটি ৮ লাখ ২৫ হাজার ৫৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬ লাখ ৫২ হাজার ১০৭ জন দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৭৮ কোটি ৩১ লাখ ৯ হাজার ৭০০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজারেরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। ভারতের শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেলে পড়াশোনা করছেন। শুধু ভারতই নয়, নেপাল ও ভুটানের শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কয়েক শতাধিক। দেশে বর্তমানে অর্ধশতাধিক সরকারি ও ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সাধারণ শিক্ষার কারিকুলামেও পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন কারিকুলামের পাইলটিং শুরু হচ্ছে। পুরো শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। গত কয়েক বছর আগেও যেখানে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ, এখন সেখানে ভর্তির হার প্রায় ১০ শতাংশেরও বেশি। যদিও সরকার দাবি করছে ১৭ শতাংশ। দেশে-বিদেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদার প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষায় স্বপ্রণোদিত হয়েই শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসছে। আগে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী কিংবা পাবলিক পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্টধারীরা কারিগরিতে ভর্তি হতো। তবে গত এক দশকে পাল্টেছে এ চিত্র। ২০১৪ সালে কারিগরিতে শিক্ষার্থী ছিল ৯ লাখ, ২০১৯ সালের শেষদিকে এ সংখ্যা ১৭ লাখ ছাড়িয়েছে। সরকার নির্ধারিত ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রার পথে এগোচ্ছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এজন্য কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
দেশের বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে কারিগরি শিক্ষায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এতে কারিগরি শিক্ষায় প্রতিবছরই ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। পিছিয়ে পড়া মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করেছে বর্তমান সরকার। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে মাদ্রাসা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। সাধারণ বিষয়ের মতো তথ্য ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান বিষয় চালু করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসার উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এনে বিশ্বমানের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দেশে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সময়ের ধারা সংবাদটি শেয়ার করুন এবং আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ

© All rights reserved © somoyerdhara.com
Desing by Raytahost.com